গাঞ্জিয়া চাল

“এই চাল শুধু খাদ্য নয়, এক হাজার বছরের প্রকৃতি-লালিত উত্তরাধিকার।”

ধরুন, একটা দানার মধ্যে লুকিয়ে আছে গল্প। গল্পটা কোনো কল্পনা নয়—এটা একটা নদীর, একটা জনপদের, আর একটা কৃষকের অন্তরের আকুতির। এমনই এক ধান আছে, যে ধানের নাম বললেই যমুনার হাওয়ার ঘ্রাণ লেগে থাকে জিভে – ‘গাঞ্জিয়া’।

আমাদের প্রোডাক্ট ইনোভেশন টিমের শুরুটা ছিল এক সোজাসাপ্টা চিন্তা নিয়ে – দেশীয় ধানের এমন এক প্রজাতির চাল খুঁজে বের করা, যেখানে থাকবে প্রকৃতির স্বাদ, মাটির ঘ্রাণ, আর কৃষকের মমতা। একেবারে প্রাকৃতিক, স্বাদে অনন্য এবং ফাইবার সমৃদ্ধ এমন এক চাল যা শুধু খাদ্য নয়, হবে এক ঐতিহ্যের পুনর্জন্ম।

কিন্তু এই পথটা একদমই সহজ ছিল না। বাংলাদেশের কৃষিবিদরা বলেন, ইতিহাসের পাতা উল্টালে দেখা যায় এই দেশে প্রায় ১৫ হাজার দেশীয় জাতের ধান চাষ হতো। আজ সেসব জাতের বেশিরভাগই হারিয়ে গেছে, বাজার অর্থনীতির চাপে, উচ্চ ফলনের লোভে, আর বৈরি পরিবেশের তালে তাল মেলাতে না পেরে। এই হারিয়ে যাওয়া ধানের মাঝে একদিন ছিল ‘গাঞ্জিয়া’—নির্জন চরাঞ্চলের এক নিঃশব্দ সোনা, যে এখনো যমুনার ঢেউয়ের সাথে লড়াই করে টিকে আছে।

আমাদের ইনোভেশন টিম তখন স্থির করলো আমরা সেই ধানটাই খুঁজবো, যেটা কোনো রাসায়নিক সার, কীটনাশক ছাড়াই বড় হতে পারে, যেটা অটো রাইস মিলে প্রক্রিয়াজাত হয় না, আর যেটা হাজার বছরের পুরনো ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। এই মানদণ্ডে আমরা যেই ধানের নাম খুঁজে পেলাম, সেটাই গাঞ্জিয়া।

এই গাঞ্জিয়া ধানের এক বৈশিষ্ট্য হলো – এটি শুধুমাত্র যমুনা বিধৌত নিচু চরাঞ্চলে, বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়ে আবাদ হয়। ফলন খুবই কম, বিঘা প্রতি মাত্র ৭-৮ মণ। বাজারে চাহিদা নেই, লাভ নেই, তাই খুব অল্প কিছু কৃষক, শুধুমাত্র নিজেদের খাওয়ার জন্য এটি চাষ করেন। কিন্তু এই ধান সারবিহীন, কীটনাশকবিহীন, প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো, এবং ফাইবার সমৃদ্ধ।

আমাদের অনুসন্ধান চলতে থাকল, এক চর থেকে আরেক চর, এক গ্রামের চায়ের দোকান থেকে আরেক কৃষকের উঠোন। এভাবেই একদিন দেখা পেলাম সেই ‘ধানের জাদুকর’–এর। নাম নয়, তাঁর পরিচয়ই যেন এক উপাখ্যান। বয়সের ভারে নত হলেও চোখে আলো আছে, মনে আছে সাহস। যিনি চোখ বন্ধ করে শুধু স্পর্শেই বলে দিতে পারেন ধান কোন বছরের, কোন মাটির, আর কোন নদীর পাশে জন্মেছে। তাঁর সাথে যখন প্রথম আমাদের দেখা, তিনি বলেছিলেন, “গাঞ্জিয়া শুধু ধান নয় ভাই, এটা আমাদের নদী-মায়ের উপহার, গাঞ্জিয়ার দানায় মাটির গন্ধ থাকে।”

এই প্রাজ্ঞ কৃষককে আমরা আমাদের প্রোডাক্ট ইনোভেশন টিমে যুক্ত করলাম। কারণ, ইতিহাস জানার জন্য বই যথেষ্ট নয়—প্রয়োজন জীবন্ত স্মৃতির। তিনি হলেন আমাদের পথপ্রদর্শক। তাঁর অভিজ্ঞতা আর ভালোবাসায়, ধান যেন তার সন্তানের মতো।

আমরা শুধু ধান খুঁজে পেলাম না, আমরা খুঁজে পেলাম এক চাষাভূমির আত্মা। এরপর আমরা তাঁর সঙ্গে মিলে গড়ে তুললাম এক বিশেষ কৃষক নেটওয়ার্ক, যারা আজও গাঞ্জিয়া চাষে আগ্রহী, অথবা আমাদের উৎসাহে নতুন করে ভাবছেন এটি চাষ করার কথা।

কিন্তু সংগ্রহ করলেই তো শেষ নয়!

এখন চ্যালেঞ্জ—এই ধান থেকে সেই আদিম, ফাইবার সমৃদ্ধ, প্রাকৃতিক স্বাদের চাল বানানো!

অটো রাইস মিলে এটা সম্ভব নয়, কারণ সেখানে চালের প্রাণটাই হারিয়ে যায়। আমাদের সেই ধানের জাদুকর জানালেন—কীভাবে সেদ্ধ করতে হবে, কতক্ষণ রোদে শুকাতে হবে, হাস্কিং মিলে কোন গতিতে চাল ভাঙাতে হবে—যাতে চালের গায়ে লেগে থাকা ফাইবার থেকে যায়, যেন দানায় দানায় থাকে প্রকৃতির ছাপ।

আমরা এগুলো অনুসরণ করে চাল তৈরি করলাম – লালাভ রঙের, রুক্ষ বাইরের আবরণে মোড়া এক বিশেষ চাল – যেটা খেলে বোঝা যায়, এটা কোনো সাধারণ চাল নয়, এটা ইতিহাসের স্বাদ। প্রতিটি দানায় লুকিয়ে আছে অতীতের ছোঁয়া, ঐতিহ্যের ছাপ।

এইভাবেই আমরা পেয়েছি গাঞ্জিয়া চাল – যমুনার পাড়ে হাজার বছরের পুরনো দেশীয় ধান থেকে তৈরি, রাসায়নিকমুক্ত, প্রাকৃতিকভাবে পরিপুষ্ট, সুস্বাদু এবং ফাইবার-সমৃদ্ধ এক অপূর্ব খাদ্য।

আপনার প্লেটেও যদি ফিরিয়ে আনতে চান প্রকৃতি, মাটি আর কৃষকের ভালবাসা—তবে গাঞ্জিয়া চালই আপনার জন্য সেরা উপহার।

প্রতিটি দানায় জড়ানো এক গর্বিত ইতিহাস, প্রতিটি রন্ধ্রে ছুঁয়ে যায় প্রাচীন বাংলার স্মৃতি।

One thought on “গাঞ্জিয়া চাল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *