এই আটা শুধুই লাল নয়—এটা আমাদের মাটির গল্প, কৃষকের ঘামের গল্প, আর হারিয়ে যেতে বসা এক সোনালী অধ্যায়ের ফিরে আসা।
শুরুটা হয়েছিল খুব সাধারণ এক ভাবনা থেকে – “লাল আটার বাজারে চাহিদা আছে, আমাদের পণ্যের তালিকায় এটাও থাকা দরকার।” কিন্তু প্রোডাক্ট ইনোভেশন টিম যখন মাঠে নামলো, তখন শুধুই আটার গল্প নয়, আবিষ্কার করলো এক বিস্ময়কর কৃষি ইতিহাস!
গম – বাংলাদেশের একটি অন্যতম পুষ্টিকর দানাদার খাদ্যশস্য। এটি শুধু খাদ্য নয়, বরং কৃষকের ঘামের, গবেষকের সাধনার আর সময়ের পরীক্ষায় টিকে থাকা এক জীবন্ত ঐতিহ্য। বহু বছর আগে এই দেশে চাষ হতো খেরী জাতের গম, যেটি আজ প্রায় বিলুপ্ত। তারপর সত্তরের দশকের শেষ দিকে সোনালিকা ও কল্যানসেনা জাতের মাধ্যমে শুরু হয় উচ্চ ফলনশীল গম চাষের পথচলা। এরই ধারাবাহিকতায় আশির দশকে বাংলাদেশের গমচাষে ঘটে এক বিপ্লব – “কাঞ্চন জাতের গম” উদ্ভাবনের মাধ্যমে।
এই কাঞ্চন জাতই আজকের “লাল কাঞ্চন” – কৃষকের মুখে মুখে নাম ছড়িয়ে পড়ে কারণ এর দানাগুলি ছিল অধিক লাল, দেখতে আকর্ষণীয় এবং খেতে সুস্বাদু। এই গমের রঙ, স্বাদ ও পুষ্টিগুণ এতটাই অনন্য যে কৃষকরা একে বলতো – “এটা আলাদা!” কৃষিবিদদের মতে, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউট উদ্ভাবিত ৩৮টি গম প্রজাতির মধ্যে কাঞ্চন জাত ছিল সবচেয়ে পরিপুষ্ট দানাবিশিষ্ট, যা সরাসরি পুষ্টিমানের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত।
কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য – এই অসাধারণ গমটি আজ আর বাজারে পাওয়া যায় না। কেননা এটি তুলনামূলক কম ফলনশীল এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম। ফলে কৃষকেরা ঝুঁকে পড়ে বিজয়, শতাব্দী, প্রদীপের মতো নতুন প্রজাতির দিকে।
তবুও থেমে থাকেনি আমাদের ইনোভেশন টিম। তারা খুঁজতে থাকে সেই মানুষগুলোকে যারা ইতিহাস ধরে রেখেছেন—যারা এখনো “স্বাদের জন্য, নিজের খাওয়ার জন্য” লাল কাঞ্চন চাষ করেন। উত্তরবঙ্গের নীলফামারী, ঠাকুরগাঁও ও পঞ্চগড় জেলার কিছু প্রত্যন্ত গ্রামে খুঁজে পাওয়া গেল হাতে গোনা কয়েকজন কৃষক। নীলফামারীর জলঢাকার এক প্রবীণ কৃষক আমাদের বললেন, “এই কাঞ্চন গম এলা হয় না ব্যাহে, মুই আগোত কচ্ছিনু, এলা করো না।” আরেকজন বলেন, “লাল কাঞ্চন তো খাইতে স্বাদ ভালো, হ্যাস্কারী বটে।”
এই আবেগ, এই স্বাদ, এই ইতিহাসই আমাদের অনুপ্রাণিত করে। আমরা শুধুমাত্র একটা পণ্য নয়, বরং একটা নস্টালজিয়া পুনরুজ্জীবিত করতে চাই। সেজন্য, নেকবক্ত গ্রামে এবং আশেপাশের কিছু এলাকায় আমরা গড়েছি একটি বিশেষ কৃষক নেটওয়ার্ক – যারা প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন আমাদের জন্য লাল কাঞ্চন গম আবাদ করবেন।
এই গম থেকে আমরা তৈরি করছি “লাল কাঞ্চন গমের লাল আটা” – যা শুধুমাত্র আটা নয়, বরং একটি ঐতিহ্যের স্বাদ, হারিয়ে যাওয়া ইতিহাসের পুনর্জন্ম, এবং আগামী প্রজন্মের জন্য এক প্রাকৃতিক উপহার।
আমরা চাই, আপনি শুধু এক প্যাকেট আটা কিনবেন না—আপনি এই গল্পের অংশ হবেন। এক চুমুক চা যেমন গল্প শুরু করে, তেমনি একটি রুটি বা পরোটার কামড়ে আপনি ইতিহাসে ফিরে যাবেন।
লাল কাঞ্চন গমের লাল আটা—খাদ্যের মাঝে অতীতের ছোঁয়া, স্বাদের মাঝে ভবিষ্যতের আশা।